IQNA

ধর্মান্তরিত অদম্য নারীর গল্প

23:35 - March 17, 2018
সংবাদ: 2605284
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: হাদিয়া শেষ পর্যন্ত তার ব্যক্তি স্বাধীনতার আইনি লড়াই জিতে গেলেন। ভারতের শীর্ষ আদালত ফিরিয়ে দিল তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। তবে অখিলা থেকে হাদিয়া হবার লড়াইটা ছিল দীর্ঘ, বিচার প্রক্রিয়া ছিল প্রলম্বিত। তবুও হাল ছাড়েননি হাদিয়া।


বার্তা সংস্থা ইকনা: প্রথমে হাইকোর্ট, তারপর জাতীয় তদন্ত এজেন্সি, শেষে সুপ্রিম কোর্ট। এ সময় অসহ্য মানসিক চাপ এবং হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছিল হাদিয়াকে। তাই তো, মামলার পরিণতির দিকে তাই তাকিয়েছিল গোটা দেশ। কিন্তু বিতর্কিত মামলার মূল বিষয়টা ঠিক কী ছিল?

ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালার ২৪ বছর বয়সী হিন্দু তরুণী অখিলা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম নেয় হাদিয়া। নিকাহ করেন মুসলিম যুবক সাফিন জাহানকে। তরুণীর বাবা তা মেনে নিতে পারেননি। বাবা কে. এম অশোকান কেরালা হাইকোর্টে যান, এই বিয়ের বিরুদ্ধে।

বাবার অভিযোগ, কথিত লাভ জিহাদের জেরে তার মেয়েকে ফুঁসলিয়ে মগজ ধোলাই করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। এটা মুসলিম মৌলবাদী কিছু গোষ্ঠীর লাভ জিহাদের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই না। এই ভাবে হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধদীর্ণ দেশে পাচার করা হচ্ছে।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে কেরালা হাইকোর্ট এই বিয়েকে নিছক ধোঁকাবাজি বলে বাতিল করে দেন। হাদিয়াকে পিতৃগৃহে থাকার নির্দেশ দেন। যদিও হাদিয়া আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি সাফিনকে নিকাহ করেছেন স্ব-ইচ্ছায়, চাপে পড়ে নয়।

হাদিয়ার স্বামী সাফিন জাঁহান এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট গত বছরের নভেম্বর মাসে কেরালা হাইকোর্টের রায় খারিজ করে হাদিয়াকে পিতৃগৃহের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে থাকার অনুমতি দেন। হাদিয়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হোমিওপ্যাথির একটা কোর্স করছিলেন, সেটা যাতে সে সম্পূর্ণ করতে পারেন।

আপাতদৃষ্টিতে এই রায়ও হাদিয়ার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। তার কথায়, এক প্রাপ্ত বয়স্ক নারী হিসেবে কেন সে স্বামীর সঙ্গে থাকার অধিকার পাবে না, যাকে সে স্বেচ্ছায় নিকাহ করেছেন? এটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্ন।

অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারকের বেঞ্চ রায় দেন, ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী হাদিয়ার বিয়ে সঙ্গত এবং বৈধ। তাই স্বামীর সঙ্গে থাকার অধিকার হাদিয়ার আছে।

এই রায়ে অসন্তুষ্ট পিতার প্রতিক্রিয়া, তিনি রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন। তিনি মনে করেন, তার মেয়েকে তুলে দেওয়া হলো এক সন্ত্রাসবাদীর হাতে। তিনি এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই এখনো চালিয়ে যাবেন, জাতীয় তদন্ত এজেন্সি এনআইএ-কে দিয়ে বিশদ তদন্তের দাবি জানাবেন।

ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার আদায়ে হাদিয়ার আইনি লড়াই সম্পর্কে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘এটা সারা ভারতে সাড়া জাগানো এক মামলা। যদিও শেষমেষ সর্বোচ্চ আদালত তার বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাকে ধর্মনিরপেক্ষতার নজির বলে ধরা যেতে পারে।’

‘তার আগে প্রশ্ন উঠেছে একই আইন একটা হাইকোর্ট, যেটাকে তো কম বলা যাবে না, সেই বিয়েটা মানলো না কেন? আলোচনার সূচিতে প্রায় উঠে আসছে বিচারবিভাগে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া পড়ছে কিনা। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে। শুধু তাই নয়, আঙুল উঠছে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের প্রভাব খাটানোর দিকে। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও অনেকটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। তাই হাদিয়ার কেসটা অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘তবে এই ধরনের ঘটনা যে ঘটবে না তা বলা যায় না। এ রকম আরও অনেক কেস আছে। যেমন রাজস্থানে যদি উঁচুজাতের পুরুষ নীচু জাতের কোনো নারীকে ধর্ষণ করে, তাহলে সেটা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় হাদিয়ার পক্ষে গেলেও বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের ছাপ পড়ছে যেটা যথেষ্ট চিন্তার কারণ।’ ডয়চে ভেলেকে এমনটাই বলেন গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত।

অন্যদিকে, হাদিয়া মর্যাদাহানি এবং দীর্ঘ দুই বছর ধরে মানসিক ধকল এবং হয়রানির জন্য কেরালা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। বলেছেন, আমার জীবন থেকে অতি মূল্যবান দুটো বছর খোয়া গেছে।

বাবার কাছে সে ক্ষতিপূরণ চায়নি। কারণ তার ধারণা, তার বাবা-মাকে কিছু কট্টর হিন্দুত্বাবাদী সংগঠন রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তাদের ওপর প্রভাব খাটিয়েছিল। হাদিয়ার স্বামী সাফিন জাহান বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রভাব থিতিয়ে যাবার পর তিনি হাদিয়ার বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। কারণ ইসলাম গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শেখায়।

ভারতের মতো দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর নিজের জীবন বেছে নেবার অধিকার ও স্বাধীনতা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মারপ্যাচে খণ্ডিত হয়। আইনও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি এটাও ঠিক, সংগঠিত মৌলবাদীদের ধর্মান্তরণের চক্রান্তের উপযুক্ত তদন্ত হওয়া দরকার। নিছক সন্দেহের বশে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত। ডয়চে ভেলে

captcha